ধ্বংসস্তূপের নিচের দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেলেন সকলে
- আপডেট সময় : ০৫:১৭:৫৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ৯৭ বার পড়া হয়েছে
অনলাইন ডেস্ক: টানা আটদিন ধরে চলছে গাজায় ইসরায়েলের বিমান ও কামান হামলা। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মুহূর্তেই ভেঙে পড়ছে বহুতল ভবন। তেমনই ইসরায়েলের রকেট হামলায় ভেঙে গুড়িয়ে গেছে গাজার ৩ তলা একটি বহুতল ভবন।
ভবনটির ধ্বংসস্তূপে কেউ আটকে আছেন কি না, তার খোঁজ চালাচ্ছিল উদ্ধারকারী দল। তখনই ধ্বংসস্তূপের নিচে একটি দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন উপস্থিত সকলেই। অবতারণা হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের।
কংক্রিটের বড় বড় চাঙড় সরাতেই উদ্ধারকারীরা দেখেন, নিথর হয়ে পড়ে রয়েছেন এক নারী। তার পাশেই শোয়া এক মাসের একটি শিশু। সে তার মায়ের স্তন্যপান করছে। এই দৃশ্য দেখে উদ্ধারকারী দলের অনেকেই কেঁদে ফেলেন। খবর দ্যা মিরর।
গাজাবাসীদের খাবার পানি সরবরাহের কাজ করেন আহমেদ। বোন ও বোনের শিশুটিকে বাসায় রেখে কাজে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফিরে দেখতে পান তার তিনতলা বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তার এক মাস বয়সী ভাতিজা ইয়ামেনকে ধ্বংসস্তূপের নিচে বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে অবরুদ্ধ অঞ্চলটির শিশুদের ওপর। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, অবরুদ্ধ ছিটমহলে ইসরায়েলের চলমান বোমাবর্ষণে নিহতদের অন্তত ৬০ শতাংশ শিশু ও নারী।
এছাড়া ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ডাক্তার এবং সাহায্য সংস্থাগুলি বলেছে যে চলমান হামলায় তাদের বেশীরভাগ রোগী শিশু।
“এর কারণ হল গাজায় আহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আবার তারা প্রায়শই বিমান হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িগুলোতে থাকে,” গাজায় ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর ডেপুটি প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর আয়মান আল-জারুচা জানান।
গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ১৮ বছরের কম বয়সী। অর্থাৎ ১০ লাখের মতই শিশু অবরুদ্ধ এই অঞ্চলটিতে। আর ইসরায়েলের এবারের হামলাকে গত ১৫ বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা বলা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বার বার ইসরায়েলের হামলায় গাজার প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে চারজনই হতাশা, শোক এবং ভয়ের সাথে বসবাস করছে। এদের অর্ধেকেরও বেশি আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা এবং অন্যান্য শিশুদের মৃত্যু চোখে সামনে দেখার মত মানসিক আঘাতের সাথে লড়াই করে।
এখন পর্যন্ত গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের হামলার আট দিন অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অঞ্চলটিতে অন্তত ২ হাজার ২১৫ জন নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের মধ্যে ৭২৪ জনই শিশু। শুধু তাই নয়, ৮ হাজার ৭১৪ জন আহত ফিলিস্তিনির মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু রয়েছে।
শিশুদের কাছে যুদ্ধের ভয়াবহতা লুকানো সম্ভব না হলেও সন্তানদের সামলাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন মা-বাবারা। গাজা শহরে বসবাসরত চার সন্তানের মা সামাহ জাবের (৩৫), তার ১৩ বছর বয়সী বড় ছেলে কুয়াসির জন্য চিন্তিত।
সামাহ বলেন, “সে খুব উত্তেজিত থাকে এবং আজকাল অন্য শিশুদের প্রচুর মারধর করছে। যে কোনো শব্দে লাফ দিয়ে উঠে সে। কেউ জোরে কথা বললেও সহ্য করতে পারে না, এমনকি যদি তারা রসিকতাও করে।
তিনি আরও বলেন, “আমি তাকে প্রতিনিয়ত বুঝানোর চেষ্টা করি যে এই যুদ্ধ শেষ হবে।“
জাবের যতবার পারে কুয়াসিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। যুদ্ধ শেষ হলে তারা কী কী করবে, এসবের পরিকল্পনার কথা শোনায় কুয়াসিকে। জাবের জানান, এ আচরণ কুয়াসিকে যুদ্ধের এ ভয়াবহ সময়টাকে জয় করতে সাহায্য করবে এবং এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগাবে।
রাফা শহরের বাসিন্দা ও এক মা আহলাম ওয়াদি (৩০) বলেন, তাঁর ১০ বছর বয়সী ছেলে নিজের হাত দিয়ে কান ঢেকে ঘুমায়। না হলে সে ভয়ে আতঙ্কে ঘুমাতে পারে না। ওয়াদি তাঁর সন্তানদের নিজের ছেলেবেলার গল্প শোনান। তিনি বলেন, ‘আমিও আমার ছেলেবেলায় এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছি। এজন্যই এখন আর ভয় পাই না।’
গাজা সিটিতে বসবাস করা মানাল সালেম, তিন সন্তানের জননী তিনি, তাঁর স্বামী একজন চিকিৎসক। কাজের জন্য প্রায় রাতেই বাসায় ফিরতে পারেন না তিনি। এ সময় শিশুরা বাবার জন্য বেশ চিন্তিত থাকে। তাঁদের ছোট মেয়ে ৬ বছর বয়সী মাইয়ের ধারণা, ইসরায়েলি বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মারা গেছেন তার বাবা, তাই বাসায় ফিরছেন না। এ সময় মাইকে খুব চিন্তিত আর বিষণ্ণ দেখায়।
খান ইউনিসে বাস করা ১৪ বছর বয়সী আয়েদ আল জাজিরাকে জানায়, “আমি আমার মাথা থেকে নিহত বা ধ্বংসস্তূপের নীচে আহত শিশুদের ছবি স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছি না। কানে সব সময় আহত শিশুদের ব্যথায় চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে।
সে আরও বলে, আমি কল্পনা করতে পারি না যে এত ছোট দেহের শিশুরা কীভাবে এই বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র সহ্য করতে পারে, আমি বুঝতে পারি না যে কীভাবে তাদের সাহায্য করার জন্য কেউ কিছু করে না। গাজার শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে।“
আয়েদ জানান, “তারা আমাদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে।“
বাস্তুচ্যুত শিশু
নাইমা ফারেস, উত্তর গাজা উপত্যকায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বেইত হ্যানউনে ছয় সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরুর পর বাস্ত্যুচ্যুত হয়েছেন তারা। জাতিসংঘের একটি স্কুলে আশ্রয় নেন তিনি।
দুই পক্ষের এই যুদ্ধে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছে এই অঞ্চলের শিশুরা।
নাইমা বলেন, “আমরা আমাদের বাচ্চাদের বলতাম বাড়ির চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর নেই। কিন্তু এই যুদ্ধ সব নিয়ম ভঙ্গ করেছে। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন, আমরা আমাদের ঘর থেকে কিছু না নিয়ে দৌড়ে বের হয়েছিলাম, এমনকি কাপড়ও বদলানো হয়নি।“
তিনি আরও বলেন, ‘হামলার দ্বিতীয় রাত থেকেই ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমার সন্তানেরা।’
ফারেসের মেয়ে হানিন (১৬) আল জাজিরাকে জানান, “এই যুদ্ধ খুব ভয়ঙ্কর। তারা আমার শৈশব ও স্বপ্নকে হত্যা করেছে। আমার কাছে এমন কিছু নেই যা আমাকে আর খুশি করে।”