সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা প্রশাসকের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনায় এলাকাবাসী

- আপডেট সময় : ০৬:০০:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অক্টোবর ২০২৩ ১০৪ বার পড়া হয়েছে
সাতক্ষীরা কন্ঠ ডেস্ক : সপ্তাহ ব্যাপী টানা ভারীবর্ষণে সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর, ব্রহ্মরাজপুর ও ফিংড়ি ইউনিয়নের ২৭ টি গ্রামসহ শহরের কয়েকটি এলাকায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দুর্বিষহ অবস্থা। মানুষ ও গবাদিপশুর করুণ আর্তনাদে এসমস্ত এলাকার আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে। সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে জীবন সংসার পরিচালনা করা যে কত কঠিন?
তা এসব ডুবন্ত এলাকা পরিদর্শন না করলে অনুধাবন করা যাবেনা। ইতোঃমধ্যে মানুষের বসত বাড়িতে পানি প্রবেশ করায় গ্রামের অনেকেই প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ও গবাদিপশু নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্রে আশ্রয় নিচ্ছে। বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর নব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় এজনপদে বিগত একযুগ ধরে জলাবদ্ধতার কারণে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কল্পনাতীত।
টানা এক সপ্তাহ ভারীবর্ষণের ফলে সাতক্ষীরা সদরের কয়েকটি ইউনিয়নের ২৫/২৭ টি গ্রামে স্থায়ী জলাবদ্ধতা যেন “মড়ার পর খাঁড়ার ঘা” হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির কারণে সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা এলাকা হতে শুরু করে ধুলিহর, ইউনিয়নের স্থায়ী জলাবদ্ধতায় দামারপোতা, বাগডাঙ্গা, বড়দল, জিয়ালা, গোবিন্দপুর, নাথপাড়া, কাজিরবাসা, তালতলা, বালুইগাছা, ধুলিহর সানাপাড়া, জাহানাবাজ, কোমরপুর, দরবাস্তিয়া এবং চাঁদপুর গ্রামের অধিকাংশ জায়গায় ভয়াবহ রূপে স্থায়ী জলবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া ফিংড়ী ইউনিয়নের ফয়জুল্যাপুর, বালিথা, শিমুলবাড়ীয়া, এল্লারচর, ফিংড়ী, গাভা, ব্যাংদহা, জোড়দিয়া, গোবরদাড়ী, সুলতানপুর, মজলিসপুর, হাবাসপুর ও কুলতিয়াসহ ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের মাছখোলা, নুনগোলা, রামচন্দ্রপুর, চেলারডাঙ্গা, বড়খামার, মেল্লেকপাড়া, উমরাপাড়া বাঁধনডাঙ্গাসহ সাতক্ষীরা পৌরসভার ৫ টা গ্রামে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার কালো ছোবল হানা দিয়েছে। অতীতে এসমস্ত এলাকায় কৃষকদের উৎপাদিত ফসলে এলাকার হাটবাজার গুলোতে মাছ সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে ভরপুর থাকতো। মনে হতো “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা”।
আজ এসব শুধুই কল্পনা। স্থানীয় বড়দলের একাধিক কৃষকের সাথে সাক্ষাৎকারে তাদের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আশা আকাঙ্খার কথা এভাবে ব্যক্ত করেন- কৃষক আফছার আলী বলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে বসত বাড়িতে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে দশ কাটা জমিতে বেগুন , বরবটি, করলা, লাউ, শিম, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছিলাম টানা বর্ষণের ফলে জলাবদ্ধতায় সব সবজি গাছ মরে গেছে রয়েগেছে অপূর্ণ স্বপ্ন। অতৃপ্ত কামনায় মগ্ন চিন্তায় অনেকের নির্ঘুম রাত পার করতে হচ্ছে এলাকায়। গ্রামে প্রায়:শ বাড়িতে বিভিন্ন সবজি চাষ করেছিল নারীরা ।
জলাবদ্ধতার অভিশাপে ধূলিসাৎ হয়ে গেল বশত বাড়িতে সবজি চাষের সব পরিকল্পনা আর শ্রম। একই গ্রামের অপর কৃষক আশরাফ আলী ও মোকছেদ সরদার যৌথ ভাবে তিন বিঘা জমিতে সমিতি থেকে লোন নিয়ে আউশ ধান চাষ করেছিল কান্নাভেজা চোখে বলে আমাদের সব শেষ। এবছর আর ধানকাটা লাগবে না। অধিকাংশ কৃষক তাদের চাষের জমিতে আউশ বা আমন ধান কোনোটাই চাষ করতে না পেরে হতাশায় ভেঙে পড়ছে। উপার্জনের কোনো পথ খোলা না থাকায় চিন্তিত কিভাবে সংসার চলবে?
ফয়জুল্যাপুর গ্রামের কৃষক অরবিন্দ মন্ডল বলেন এসব এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা আমন ধান চাষ করতে না পারায় ব্যাপক অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত কয়েক মাসের বর্ষণে সৃষ্ট ভয়াবহ জলবদ্ধতার কারনে এসব এলাকার শতশত একর জমিতে আমন ধান চাষ করা সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরা থেকে বিগত কয়েক বছর আম বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বিশ্ব পরিমন্ডলে সুনাম ছড়িয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হয় বৈদেশিক মুদ্রা।
ধুলিহরের গোবিন্দপুর কাজিরবাসা এলাকার কয়েকজন আম চাষীর সাথে কথা বললে আমজাদ হোসেন, রওশন আলী ইয়াছিন মোল্লা বলেন দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতার কারণে আমাদের এলাকায় আম গাছগুলো বাঁচানো দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে অত্র এলাকায় আমের ফলনও সন্দিহান। গত একযুগ যাবত বেতনার তীরে অবস্থিত এই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার রাহুগ্রাসে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ, গবাদিপশু এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশু পাখি। মৌসুম ভিত্তিক প্রতি বছর জ্যোষ্ঠ-আষাঢ় মাস আসতে না আসতেই সামান্য বৃষ্টিতে সাতক্ষীরায় বেতনার পাড়ে এসব গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়।
পানিবন্ধি হয়ে পড়ে বিলকে বিল ফসলি জমি। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন স্থায়ীভাবে সৃষ্ঠ জলাবদ্ধ এসব এলাকার মানুষের মধ্যে মহামারি আকারে অকাতরে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগবালাই। ডেঙ্গুর কারণে দেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মরলেও এসমস্ত এলাকায় যেন সেবিষয়ে তোয়াক্কা করার জোঁ নেই। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ডুবে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মানুষের খাবারের পাশাপাশি এসব এলাকায় গোঁ-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরা পৌরসভার অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে পৌরসভার পানি ধুলিহর ও ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের খাল বয়ে বেতনা নদীতে নিষ্কাশন হতে না পারায় এসব এলাকার মানুষকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা শিকার হতে হয় বলে জানান ধুলিহর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. মিনহাজ মোর্শেদ। এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বেতনা নদীখনন ও এসমস্ত এলাকার খালখননের দাবীতে জেলা পানি নিষ্কাসন ও বাস্তবায়ন কমিটি, জেলা নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন গত একযুগ ধরে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন ও আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে।
সাতক্ষীরা স্থানীয় দৈনিক বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রতি বছর জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের দুর্বিষহ ভোগান্তির বর্ননা দিয়ে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় বর্তমান সরকার ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বেতনা নদীখনন কাজ এবছর শুরু করলেও তা কবে নাগাদ শেষ হবে তার কোন ইয়াত্তা নেই। অতিধীর গতিতে চলছে নদীখননের কাজ।
ফলে জলাবদ্ধতার শিকার এসব এলাকায় মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধ এলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জনদুর্ভোগের অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে নদীপাড়ের মানুষ। গত ৫ই অক্টোবর বরেন্য ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমানের নানা শ্বশুর ধুলিহর বড়দল গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মো. আব্দুল বারী হাজীর দাফনের করুণ দৃশ্য বর্নণা করে একই গ্রামের মো. আজহারুল ইসলাম। অনেকেই বেতনা নদীখনন কাজের অগ্রগতি দেখে আশার আলো না দেখে হতাশ হয়ে সাতক্ষীরা প্রাণ সায়ের খালের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন।
ধুলিহর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী জলাবদ্ধতা নিরসনে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে গত ২৮শে সেপ্টেম্বর শুপারিঘাটা হয়ে বেতনা নদীতে এবং সেই পানি আবার নেহালপুর স্সুইস গেট দিয়ে তালা উপজেলা দোলুয়া কপোতাক্ষ নদীতে পড়েছে। জেলা প্রশাসক এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় এই দুর্বোধ্য কাজটি করেছেন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। শহরের বদ্দীপুর কলোনি থেকে শুরু করে ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের কিছু অংশ মিলে দামারপোতা, গোবিন্দপুর, বড়দল, সানাপাড়া, জেয়ালা, বাগডাঙ্গী, বালুইগাছা, কাজীরবাসাসহ আশেপাশের আবদ্ধ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গ্রহণের করেছিলেন।
কয়েক দিনে পানিবন্দি মানুষের মুখে কিছুটা হাঁসি ফিরলেও বিগত সপ্তাহে ভারী বর্ষণে আবারও পূর্বের ন্যায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিকল্প পথে নিষ্কাশনে পানির গতিপ্রবাহ কমতে থাকলেও জলাবদ্ধতা যেন আবারও স্থায়ীরূপ নিয়েছে। এযেন আজন্মই পাপ। ইতোমধ্যে ফিংড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: লুৎফর রহমান এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
এসব এলাকার খালে নেটপাটা অপসারণ করতে চিরুনি অভিযান চালিয়ে তিনি। জলাধার অবমুক্ত করণে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জনসচেতনতায় এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। তারপরও কিছু অসাধু লোকজন নেটপাটা দিয়ে মাছ ধরে আসছে বলে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন।
ধুলিহর গোবিন্দপুর গ্রামের মিডিয়াকর্মী মেহেদী হাসান শিমুল জানান- গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতায় আমার বসতবাড়ি সহ এলাকার অধিকাংশ বসতঘরের মধ্যে পানি ওঠায় আমরা অসহনীয় দূর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করছি। বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে প্রতি বছর এসব এলাকার অসংখ্য রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে শতশত ঘের ও পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ায় মৎস্যচাষীরা পথে বসেছে।
এলাকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চরম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক। জলাবদ্ধ এই এলাকায় বসবাসকারীদের দেখে বোঙ্কিম চন্দ্রের ভাষায় বলতে হচ্ছে “ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্র পল্লিতে এখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না “।
প্রতিবছর জলাবদ্ধতার কারণে ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামের পালপাড়ায় মৃৎশিল্প হাড়ি , পাতিল,কলস,টালিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরির মাটি ও কারখানা পানিতে ডুবে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প আজ বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে বলে জানান বাসুদেব পালসহ অন্যান্যরা। জলাবদ্ধ এলাকাবাসী স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।